প্রবৃদ্ধি উন্মোচনে নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি দৃষ্টি দিন

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রকাশিত সর্বশেষ গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী এটি পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত পৃথিবীর সকল প্রান্তেই অতিমারীর প্রভাবে সবচেয়ে দুর্বল এবং দরিদ্ররাই নির্বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশে এর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ সংখ্যক সদ্য বেকার হওয়া নারী শ্রমিক, যার কারণ লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া গার্মেন্টস কারখানাসমূহ।

বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধশালী সমাজ তৈরিতে নতুন নতুন বাধার সৃষ্টি করেছে। নারীরা প্রায়শই গার্মেন্টস, খাদ্যসেবা ও ব্যক্তিগত সেবার মত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর সম্মুখসারিতে থাকায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কৌশলে অবশ্যই ক্রমবর্ধমান জেন্ডার বৈষম্য কমানোর ব্যাপারটি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রত্যেক দেশেরই দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এরই ফলে বাংলাদেশ বিগত কয়েক বছরে তৈরি পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তবুও এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ কেবল স্বল্প বেতনের কর্মেই সীমাবদ্ধ- যা কর্মবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে ব্যর্থতার নিদর্শন।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সদ্য প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ সূচক ২০২১ এর র‍্যাংকিং এ এক বছরে বাংলাদেশের ১৫ ধাপ অবনমন ঘটে ১৫৬টি অর্থনীতির মধ্যে ৬৫তম স্থানে আছে। দেশটি তবুও এর দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশী নেপাল (১০৬তম), শ্রীলঙ্কা(১১৬তম), ভুটান(১৩০তম), ভারত(১৪০তম) ও পাকিস্তান(১৫৩তম) এর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে।

জেন্ডার বৈষম্য কমানোর জন্য অতিমারি-উত্তর প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করার মাধ্যমে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে। পরামর্শদাতা সংস্থা ম্যাককিনসী এন্ড কোম্পানীর এক রিপোর্ট অনুযায়ী জেন্ডারসমতা ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ জিডিপিতে ৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি আনতে পারে, অর্থমূল্যে যা প্রায় ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের সমতুল্য।

স্থানীয় অর্থনীতিতে নারী উদ্যোক্তারা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার সুস্পষ্ট প্রমাণ রাখা সত্ত্বেও বাণিজ্যে তাদের সম্পৃক্ততা খুবই কম। মাস্টারকার্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনডেক্স অফ উইমেন এন্ট্রাপ্রেনিউরস ২০২০ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট উদ্যোক্তাদের কেবল ৪.৫ শতাংশই নারী, যা ভারতের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে, যেখানে ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের ৫.২ শতাংশ নারী।

এই নারী মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর বেশিরভাগই মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, এবং এদের সাফল্য বিশ্বের অন্য সব অর্থনীতির মত বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির জন্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি বাংলাদেশের জন্যে অত্যন্ত সুফল বয়ে আনবে। সুখবর এই যে, বাংলাদেশ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়ে বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থার বিনিয়োগ থেকে উপকৃত হতে পারে। এমনই একটি উদ্যোগ উইকানেক্ট ইন্টারন্যাশনাল, একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক যা নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়ের সঙ্গে মানসম্পন্ন বায়ারদের সংযোগ সাধন করে।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক, বৈশ্বিক এই অলাভজনক সংস্থাটির লক্ষ্য নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়সমূহের দিকে অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করতে সহায়তা করা, যাতে তারা বিশ্ববাজারে আরো ভালোভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ (ডব্লিউবিজি) এর সাথে যৌথভাবে উইকানেক্ট ইন্টারন্যাশনাল স্থানীয় নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়সমূহকে স্থানীয় ও বহুজাতিক কর্পোরেশনসমূহের সাথে সংযোগ এবং বাণিজ্যের সুযোগ প্রদান করে। বাংলাদেশে এমন উদ্যোগসমূহের মধ্যে এটি প্রথম দিকের একটি উদ্যোগ, যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের নারীদের জন্যে মার্কেট লিংকেজ ও আরো বিস্তৃত বাজার সুবিধার সম্ভাব্যতা যাচাই করা।

বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে, ডব্লিউবিজি ও উইকানেক্ট ইন্টারন্যাশনাল এপেক্স ফুটওয়্যার, ব্র্যাক ব্যাংক, ডিবিএল গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নীট এশিয়া লিমিটেড, ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল এবং ওয়ালমার্ট ভারতের সাথে মিলে প্রথম সাপ্লায়ার ডাইভার্সিটি এডভাইজরি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক সোর্সিং এর পরিবর্ধন ও একই সাথে জেন্ডার অন্তর্ভুক্তিমূলক সোর্সিং লক্ষ্যমাত্রা, এবং আরো বিস্তৃত ব্যবসায়ী পরিমণ্ডলের সঙ্গে শিক্ষামূলক দৃষ্টান্ত সম্পর্কে আলোচনা করেছে।

উক্ত সংগঠনের সঙ্গে নিবন্ধিত হওয়ার মাধ্যমে লেদারিনা প্রাইভেট লিমিটেডের সিইও তাসলিমা মিজি, ওপাস টেকনোলজির পরিচালক আকতার আফরিন এবং অরণ্য ক্রাফটস লিমিটেডের সিইও নওশিন কবীর এর মত বাংলাদেশী নারী ব্যবসায়ী নেতারা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী ও বৃহৎ কর্পোরেশনসমূহের সাথে তাদের ব্যবসায় উপস্থাপনা ও বিক্রয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন।

সচেতনতা বৃদ্ধি ও পরিবর্তন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সম্প্রতি উইকানেক্ট ইন্টারন্যাশনাল এর ১১০টিরও বেশি বৈশ্বিক সদস্যদের জন্য চালু করেছে এক বছরব্যাপী “রাইজ টু দা চ্যালেঞ্জ”। ইনটেল, ইউনিলিভার, লজিটেক এবং মুডিস এর মত বৃহৎ বহুজাতিক সংগঠনসমূহ নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়ে ব্যয় বাড়ানোর জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে এগিয়ে এসেছে। কোম্পানীসমূহ ৮ মার্চ, ২০২২ পর্যন্ত সময় পাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার।

এছাড়াও পরিবেশ, সামাজিক ও প্রশাসন সম্পর্কীয় অন্যান্য দায়িত্বের সাথে সাথে নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়ের প্রতি এরকম প্রকাশ্য সমর্থনও যেন পরিবেশ, সমাজ ও প্রশাসনিক স্লোগানসমূহের বাস্তবায়নের দিকে লক্ষ্য রাখে তা নিশ্চিত করতে হবে।

ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এর সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বের বেসরকারি খাতের মোট ব্যবসায়ের মাত্র ৩০ শতাংশই নারী মালিকানাধীন। তদুপরি, উইকানেক্ট ইন্টারন্যাশনালের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও এলিজাবেথ এ ভ্যাজকেজ বলেন, গড়ে নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়সমূহ সাপ্লাই চেইনে বৃহৎ কর্পোরেশন ও সরকারসমূহের ব্যয়কৃত অর্থের এক শতাংশেরও কম আয় করে।

এদের ব্যয়কৃত অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে বৃহৎ আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনসমূহ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী নারী মালিকানাধীন ব্যবসায়সমূহে সম্মিলিতভাবে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ প্রভাব রাখতে পারে।

নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি আরো নজর দেয়ার মাধ্যমে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে দেশের অর্থনীতিকে আরো স্থিতিশীল ও জেন্ডার সমতাপূর্ণ করে তোলার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের নেতাদের।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রাক্তন ইউএস এম্বাসেডর কার্টিস এস শিন পরামর্শক সংস্থা রিভারপিক গ্রুপ, এলএলসি এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং নারী এবং আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এর সমর্থক স্টেসি নেভাদোমস্কি বেরদান উইকানেক্ট ইন্টারন্যাশনাল এর একজন উপদেষ্টা হিসেবে সাথে আছেন।